ধারাবাহিক ইসলামিক উপন্যাস (পর্ব-১)
জেরুজালেম থেকে
৫ মাইল দূরে এক সরাইখানা। চারপাশে তার উচু দেয়াল। বাইরে থেকে মনে হয় কিল্লার পাঁচিল।
এক বিষন্ন দুপুরে দ্বিতীয়বারের মত এখানে আসল আসেম। সাথে শক্ত-সামর্থ চাকর ওবায়েদ। ওরা
দামেশকে যাবার পথে একরাত এখানে অবস্থান করেছিল।
আসেম সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণ। এ ধরনের
তরুণদের কাছ থেকে মানুষ পাণউচ্ছল মন মাতানো হাসির ঝংকার শুনতেই বেশি পছন্দ করে। সে
তুলনায় তাকে একটু বেশি গম্ভীর মনে হচ্ছে। যদিও সে সুদর্শন নিটোল স্বাস্থ্যের অধিকারী
তবু তার উপর দিয়ে যে অনেক ঝড় বয়ে গেছে দেখলেই বুঝা যায়। পোশাক আশাকে সে এক সম্ভ্রান্ত
আরবেরই মত। তার ঝলমলে চোখে অহংকার, সাহসিকতা আর ব্যক্তিত্ব খেলা করছে। তার কোমরে তরবারি
ঝোলানো। পিঠে তীরে ভরা তুনীর আর ধ্নু। তেজী এক ঘোড়ার পিঠে বসেছিল আসেম। বসার সে ভঙ্গি
দেখলে মনে হয়, ডানে বায়ে সশস্ত্র দুশমন থাকলেও তার দৃঢ়তায় কোন পার্থক্য আসতনা। অথবা
আরবী পোশাক ছাড়া রোমান রোমান সৈনিকের ইউনিফর্মে থাকলে এবং পিছনে গোলামের পরিবর্তে সৈন্য
বাহিনী হলে তার নির্ভীক দৃষ্টিই ঘোষনা করত বিজয় বার্তা।
লম্বা চওড়া শরীর ওবায়েদের। আসেমের চাইতে
দশ বারো বছরের বড়। ও বসেছিল ঊটের পিঠে। আরেকটা বোঝাই উট এবং ঘোড়া নিয়ে ভিতরে প্রবেশ
করল। সরাইখানাটি দোতলা। সামনে প্রশস্ত আঙ্গিনা। খেজুর পাতায় ছাওয়া বারান্দা। বারান্দার
একদিকে সাধারন পথিকদের জন্য চাটাই পাতা। অন্যদিকে ক’খানা পুরনো টেবিল বেঞ্চ। আঙ্গিনার
একপাশে আঞ্জির আর জয়তুন গাছের বাগান। বায়ের দেয়াল লাগোয়া ছাপরা আস্তাবল হিসেবে ব্যবহ্রত
হয়। ওখানে ঘোড়া এবং উট বাঁধা। কাছেই গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিল ক’জন পথিক।
একটা টেবিলের চারপাশে বসে চারজন ইহুদী
জুয়া খেলছিল। একটু দূরে একজন দীর্ঘদেহী সিরীয় বসে বসে মদ খাচ্ছে। পোশাক আশাকে তাকে
কোন কবিলার সর্দার বলে মনে হয়। পাশে মাথা নুয়ে দাঁড়িয়েছিল তার কাফ্রী ক্রীতদাস। হাতে
মদের সোরাহী। তরবারি ছাড়াও সিরিয়টির কোমরে খঞ্জর ঝুলানো। মদের প্রভাবে জানোয়ারের মত
দেখাচ্ছে তার চেহারা।
তৃতীয়
টেবিলে দুজন খৃস্টান খানা খাচ্ছিল। জেরুজালেম জেয়ারতে যাচ্ছে ওরা। সরাইখানার মিশরীয়
মাকিল ফ্রেমস। তাদের সাথে কথা বলছিল।
আসেম
আর ওবায়েদ ঘোড়া এবং উট একটা গাছের সাথে বাঁধছিল। হঠাৎ ফ্রেমসের দৃষ্টি পড়ল তাদের দিকে।
তারাতারি ছুটে এসে বললঃ এখানে থাকতে চাইলে উট না বেঁধে বাইরে ছেড়ে দিন। ঘাসপাতা খেয়ে
নিক। ওগুলো দেখাশোনার জন্য চাকর পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ঃ
‘না, ওগুলো মালে বোঝাই, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রওনা হয়ে যাব। আমাদের চারদিন পূর্বে
যে আরব ব্যবসায়ী কাফেলা রওয়ানা করেছে তাদের ধরতে হবে। ওরা গাতফান এবং বনু কলব গোত্রের
লোক। আশা করি কয়েক মঞ্জিল পরই ওদের নাগাল পাব। আপনি ওদের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেন?’
ঃ
‘গতকাল ওরা এ পথে গেছে। সম্ভবত দু’এক হপ্তা জেরুজালেমে অবস্থান করবে।‘
ঃ
‘না’ ওরা জেরুজালেমে একদিনের বেশি অবস্থান করবে না। আরবে যুদ্ধ বন্ধের দিনগুলো প্রায়
শেষ হয়ে আসছে। আমার মত ওদেরও তাড়াতাড়ি দেশে পৌছা জরুরী। আমি আজ সন্ধার মধ্যে জেরুজালেম
পৌছতে চাই। আমাদের খাবার ব্যবস্থা করুন। আপনার যে চাকর ঘোড়ার জুতো তৈরি করতে পারে ও
যদি অবসর থাকে একটু পাঠিয়ে দেবেন। পথে হয়ত আর সুযোগ পাবনা। তাছাড়া সবখানে ভাল লোকও
পাওয়া যায় না।
ঃ’তা
হবে। এবার বলুন সফর কেমন হল?’
ঃ
‘দামেশকে ঘোড়ার দাম ভালই পেয়েছি। কিন্তু যুদ্ধের কারনে তলোয়ারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশি
আনতে পারিনি। কিছু রেশমি কাপড় এনেছি। আশা করছি কাপড়ে ভাল মুনাফা হবে। এরপর মুতা থেকে
দরকার হলে কমদামে তরবারি কিনে নেব।’
ঃ
‘ প্রার্থনা করি দেশে গিয়ে যেন শুনেন, যুদ্ধ
বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে অস্ত্র কিনতে হবে না।’
ঃ
“ আসলেও যুদ্ধে হাফিয়ে উঠেছি। দু’কবিলার বেশিরভাগ মানুষই শান্তি চায়। কিন্তু আমরা চাইনা।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এর চেয়ে বড় দঃসংবাদ আমার জন্য আর কিছুই নেই। তাহলে আমার পিতা এবং
ভাইয়ের রক্তের বদলা নিতে পারব না। আমার কবিলার বিত্তশালীরা লড়াই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
গরীবদের বিবেক এবং আবেগে এখনো ভাটা পড়েনি। কিন্তু ইহুদিদের কাছ থেকে চড়ামুল্যে অস্ত্র
কিনার সংগতি ওদের নেই। আমার বিশ্বাস, এ অস্ত্র পেয়ে কবিলার অল্প কজন ময়দানে নেমে এলে
অন্যরা ঘরে বসে থাকতে পারবে না।”
ফ্রেমস
আলোচনার মোড় পাল্টানোর জন্য বললঃ ‘আপনার ভাল ঘোড়াটাই ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন। বিক্রি করতে
চাইলে আমি ক্রেতা হতে পারি।’
ঃ
‘বিক্রি করার ইচ্ছা থাকলে আগেই করতাম। আপনার মত দামেশকেও অনেকে এর ভাল দাম দিতে চেয়েছে।
কিন্তু ও আমার উৎকৃষ্ট বন্ধু।’
ঃ
‘ঠিক আছে। আপনার যখন এতই প্রিয় তাহলে জুরাজোরি করছিনে। আমি খাবার ব্যবস্থা করছি। আপনারা
আসুন।’ আসেম ফ্রেমসের সাথে হাটা দিল। কয়েক পা এগিয়ে পেছন ফিরে ওবায়েদকে ডাকলঃ ‘এসো
ওবায়েদ।’
এই
তরুণ মনিবের সাথে ওবায়েদের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর। কিন্তু তাই বলে কারো সামনে চাকরের
সীমা অতিক্রম করতনা। ও বললঃ ‘না, আমার খাবার এখানেই পাঠিয়ে দিতে বলুন।‘
ঃ
‘আপনার এ চাকর কোত্থেকে নিয়েছেন।‘ ফ্রেমস প্রশ্ন করল।
ঃ
‘ওর সাত বছর বয়সে আমার আব্বা ওকে ইয়ামেনের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনেছিলেন। তখন আমার
জন্মও হয়নি।‘
এক
চাকরকে ঘোড়ার জুতো তৈরি করতে এবং আরেকজনকে খাবার দিতে বলে ফ্রেমস নিচে গিয়ে বসল। আসেম
বললঃ ‘ আপনার কি মনে আছে পূর্বেও একবার এখানে এসেছিলাম?’
ঃ’কবে?’
ঃ’প্রায়
বছর চারেক আগে। আব্বার সাথে ইয়ামেন যাওয়ার সময় এখানে তিনদিন ছিলাম। এরপর এক কাফেলার
সাথে গিয়েছিলাম দামেশকে। ফেরার পথেও একদিন ছিলাম।’
ঃ
‘মনে পড়ছে না। তবে এবার যাবার পথে আপনার মুখে পালি ভাষা শুনে অনুমান করেছিলাম , আপনি
পূর্বেও এসব এলাকা সফর করেছেন।’
ঃ’
আমি খুব সহজে অন্যের ভাষা আয়ত্বে আনতে পারি। দুমাস দামেশকে থাকার সময় রোমানদের সাথে
মেলামেশা করতে গিয়ে তাদের ভাষাও শিখে নিয়েছিলাম।’
পাশের
টেবিলের এক জুয়াড়ি উঠে দাঁড়ালো। কয়েক পা এগিয়ে আসেমকে বললঃ ‘ আমাদের সাথে ভাগ্য পরিক্ষা
করবে?’
ঃ
‘না, বাড়ী থেকে বেরুনোর সময় শপথ করেছিলাম, আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মদও
ছোবনা, জুয়াও খেলবনা।
ঃ
‘তা হলে তুমি আরব হতে পারবে না।’
ঃ
‘ তুমি চাইলে আমি যে আরব জুয়া না খেলেও আমি তার প্রমাণ দিতে পারি।’
ইহুদি আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসল। সিরীয়টি তখন মদের সোরাহী শুন্য করে ফেলেছে। অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে
ইহুদির কাছে গিয়ে বললঃ ‘আমি তোমাদের সাথে ভাগ্য পরীক্ষা করব।’
Comments
Post a Comment